স্কুল পর্যায়ের প্রথম শহী’দ মি’নার,মেলেনি রা’ষ্ট্রীয় স্বী’কৃতি 

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পর যখন শহীদ মিনার স্থাপনকে ঘিরে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করে ঠিক তখনি শহীদ মিনার স্থাপনে কিছু সাহসী প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে দেখা যায়। সেই সাহসী পদক্ষেপের সূচনা হয়েছিল চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে। ১৯৬৫ সালে পাক সরকারের কঠোর বাধা উপেক্ষা করে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার কধুরখীল উচ্চ বিদ্যালয়ে স্থাপন করা হয়েছিল শহীদ মিনার। এটিই স্কুল পর্যায়ের প্রথম শহীদ মিনার।

একুশের বই মেলার সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে প্রকাশিত ‘একুশের স্মারক গ্রন্থ’ এবং তৎকালীন ওই শহীদ মিনার নির্মাণে উদ্যোক্তাদের সাথে কথা বলে এ তথ্যটি নিশ্চিত করা হয়।

শহীদ মিনার নির্মাণকারী দলের অন্যতম সদস্য ও শহীদ মিনার নির্মাণ কারণে ছাত্রত্ব বাতিল হওয়া প্রাক্তন কধুরখীল উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র নুরুল হুদা ও প্রাক্তন ছাত্র সৈয়দুল আলম জীবদ্দশায় বিষয়টি নিশ্চিত করেছিলেন।

শহীদ মিনার নির্মাণকাজে যাদের অবদান অবিস্মরণীয় তারা হলেন, শাহজাদা সৈয়দ রেজাউল আকবরী, মরহুম আবুল হোসেন, সৈয়দ নুরুল হুদা, মাহাবুব উল আলম, মরহুম ফরিদ উদ্দিন জালাল, পিযুষ চৌধুরী, মিলন নাথ, যোগব্রত বিশ্বাস, আবদুস সাত্তার, দুলাল মজুমদার, আবুল কালাম আজাদ, মো. ওসমান, এস এম ইউছুফ, তসলিম উদ্দিন, জাকির হোসেন সহ তরুণদের মধ্যে ছিল মোহাম্মদ আলী, সৈয়দ জালালউদ্দিন, সৈয়দুল আলম, আবদুল্লাহ আল নোমান । পুরো বিষয়টি তদারকি করেছিলেন কধুরখীল উচ্চ বিদ্যালয়ের তৎকালীন শিক্ষক কাজী আব্দুল গণি ছাবেরী।’

একুশের বই মেলার সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে প্রকাশিত ‘একুশের স্মারক গ্রন্থ’-এর ৮৯৭ পৃষ্ঠায় ভাষা আন্দোলন গবেষক এম এ বার্নিকের লেখা ‘জেলায় জেলায় শহীদ মিনার’ অধ্যায়ে উল্লিখিত বর্ণনায় বলা হয়েছে- ‘চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে অবস্থিত কধুরখীল উচ্চবিদ্যালয় প্রাঙ্গণে শহীদ মিনার নির্মাণের দায়ে আবুল হাসান ও সৈয়দ নুরুল হুদা স্কুল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। শহীদ মিনারটি নির্মিত হয় ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৫ সালে রাত্রিবেলা। শহীদ মিনার নির্মাণের কারণে স্কুলটির বিজ্ঞান শিক্ষা বরাদ্দ ওই বছর বাতিল করা হয়েছিল।’

শহীদ মিনারকে জাতীয়ভাবে স্বীকৃতির দাবি করে আসছে ২০০৯ সালে থেকে বললেন কধুরখীল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বিশ্বজিৎ বড়ুয়া।

কধুরখীল সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বিশ্বজিৎ বড়ুয়া দৈনিক ঘোষণাকে বলেন, ঐতিহ্যেবাহী কধুরখীল সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে নির্মিত এই শহীদ মিনার বাংলাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নির্মিত প্রথম শহীদমিনার । ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান সরকারের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে তৎসময়ের কধুরখীল উচ্চ বিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র এই শহীদ মিনার নির্মান করেন। প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারির আগে বোয়ালখালী সহ প্রত্যন্ত এলাকা থেকে এই শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য আসেন। কিন্তু এই শহীদ মিনার রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি অর্জন করতে পারে নাই। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যে শহীদ মিনার নির্মাণ এটির কারণে ঐসময়ে এই বিদ্যালয়ের যারা ছাত্র ছিলেন, যারা উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন তারা অনেককেই এই বিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। এমনকি এই বিদ্যালয়ের তিনতলা বিশিষ্ট একটা বিজ্ঞান ভবন নির্মানের প্রস্তাবনা ছিল। সেই প্রস্তাবনাটিও শহীদ মিনার নির্মানের কারণে বাতিল করা হয়। ১৯৬৫ সালে ২০ ফেব্রুয়ারি এই শহীদ মিনারকে ঘিরে এক অভাবনীয় দৃশ্য সৃষ্টি হয়েছিল। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যখন শহীদ মিনার নির্মান হয় ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল বেলা মানুষের ঢল নামে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি সম্মান জানানোর জন্য। বিশেষ করে স্যার আশুতোষ সরকারি কলেজের হাজারো শিক্ষার্থী তৎসমের কলেজের অধ্যাপক জসিম উদ্দিন হায়দার চৌধুরীর নেতৃত্বে এক জাগরণ দেখতে পাই।তিনি আরো বলেন ৬০ বছর গত হয়ে গেলেও এখনো আমরা এই শহিদ মিনারের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির পাইনি। তাই আজকের সময়ে এসে এই শহিদ মিনারের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির জোর দাবি জানাচ্ছি।

সরেজমিনে কধুরখীল স্কুলে গিয়ে দেখা যায়, স্কুলের লাগোয়া ঐতিহাসিক শহীদ মিনারটিতে তিনিটি ত্রিকোণাকৃতি স্তম্ভ রয়েছে। স্তম্ভগুলো দেখতে অনেকটা পিরামিডের মতো। বেদীর নিচে লেখা রয়েছে- ‘শহীদ স্মৃতি অমর হোক’। ছোট্ট এ মিনারটি এ অঞ্চলের মানুষের বাংলা ভাষার প্রতি অগাধ ভালোবাসার অনন্য প্রতীক। জাতীয় দিবসগুলোতে স্থানীয় লোকজন ফুল দিয়ে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানায় এ শহীদ মিনারে।

কধুরখীল উচ্চ বিদ্যালয় কতৃপক্ষ এ সংক্রান্ত রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দাবি করে আবেদন করেছে বাংলা একাডেমির কাছে। বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ যাচাই-বাছাই করে এটাকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেবে এমনটি প্রত্যাশা করে বিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রী, অভিভাবক ও বোয়ালখালীবাসী।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email