একদিকে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে অবৈধ অনুপ্রবেশ করে মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সদস্যরা সশস্ত্র অবস্থায় থানচিতে নববর্ষের জলকেলিতে আনন্দ-উৎসবে মেতে উঠেছে।
অন্যদিকে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার সীমান্ত লাগোয়া ফুলতলি এলাকার দরিদ্র এক পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্যকে হারিয়ে বুকভরা শোক নিয়ে নিঃশব্দে কাঁদছে। এই চিত্র যেন বাংলাদেশের সীমান্ত নিরাপত্তার বাস্তব চিত্রই তুলে ধরছে।
স্থানীয় সূত্র জানা গেছে, থানচি ও এর আশপাশের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় সাম্প্রতিক সময়ে আরাকান আর্মির তৎপরতা অনেক বেড়েছে। এবারের থিংইয়ান বা বর্ষবরণ ও মাহা সাংগ্রাই পোয়ে উপলক্ষে তারা বাংলাদেশ সীমান্তে অবৈধ অনুপ্রবেশ করে জলকেলি, সঙ্গীতানুষ্ঠান, এমনকি স্থানীয় পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিলে উৎসব পালন করেছে। বিভিন্ন ভিডিও ও ছবি ইতোমধ্যেই সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে যেখানে তাদের অস্ত্রসহ নাচতে ও মেতে উঠতে দেখা গেছে।
এই পরিস্থিতির মধ্যেই নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার সদর ইউনিয়নস্থ ফুলতলি সীমান্ত এলাকা থেকে গত বৃহস্পতিবার (১০ এপ্রিল) ১২ দিন আগে মুফিজুর রহমান নামের এক কাঠুরিয়াকে ধরে নিয়ে যায় মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি (এএ)।
স্থানীয় ইউপি সদস্য ও স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলেন, আরাকান আর্মির সশস্ত্র সদস্যরাই তাকে ধরে নিয়ে গেছে। ধরে নিয়ে যাওয়ায় পর থেকে কোনো দাবি, বার্তা বা মুক্তিপণ সংক্রান্ত কিছুই জানা যায়নি, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
মুফিজুর রহমানের মা বলেন, “প্রতিদিন সীমান্তে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। পাহাড়ের দিকে তাকাই— যদি ছেলের মুফিজুর’র কোনো খোঁজ পাই। ১২ দিন হয়ে গেল, প্রশাসনের লোকেরা আশ্বাস দিচ্ছে, কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না। আমাদের কপাল পুড়লো।
মুফিজুরের পরিবার এখন চরম অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছেন। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হারিয়ে তারা খাদ্যসংকটেও ভুগছে।
এদিকে এ ঘটনায় বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ঘটনা শুধু একজন নাগরিক অপহরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি আমাদের সীমান্ত নিরাপত্তা, রাষ্ট্রীয় প্রস্তুতি এবং বিদেশি সশস্ত্র গোষ্ঠীর প্রতি সরকারের অবস্থান নিয়েও প্রশ্ন তোলে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সীমান্ত এলাকায় এই ধরনের উদাহরণ যদি বাড়তে থাকে, তাহলে তা শুধু স্থানীয় বাসিন্দাদের নয়, গোটা দেশের নিরাপত্তাকেই হুমকির মুখে ফেলবে। মিয়ানমারে চলমান সামরিক সংঘাতের কারণে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর একাংশ বাংলাদেশ সীমান্তের ভেতর ঢুকে পড়ছে—এটি নতুন নয়, তবে এখন তারা প্রকাশ্যে উল্লাস করছে এবং স্থানীয় জনগণের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে।
অন্যদিকে, সাধারণ মানুষের মধ্যে আশঙ্কা রয়েছে যে, এই পরিস্থিতি যদি নিয়ন্ত্রণে না আনা যায়, তবে ভবিষ্যতে এমন অপহরণ, নির্যাতন বা নিরাপত্তাহীনতার ঘটনা বাড়বে। ইতোমধ্যেই কিছু সীমান্ত এলাকা ‘নো-ম্যানস-ল্যান্ড’ হয়ে উঠেছে, যেখানে কোনো রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ নেই বললেই চলে।
বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি) ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে যে, এই বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করা হয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট কূটনৈতিক মাধ্যমে বিষয়টি মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের কাছে তোলা হয়েছে। তবে মিয়ানমারের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সেনা-বিদ্রোহী সংঘাতের বাস্তবতায় এর ফলাফল কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।
সর্বোপরি সীমান্তে এই দুই বিপরীত চিত্র—একদিকে অস্ত্রধারীদের উৎসব, অন্যদিকে নিরীহ নাগরিককে ধরে নিয়ে যাওয়া—বাংলাদেশের সীমান্ত ব্যবস্থাপনা ও জাতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার এক গভীর সংকটের প্রতিফলন। এই পরিস্থিতিতে শুধু সামরিক নয়, কূটনৈতিক ও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেও দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।