চা থেকে রান্না নানা কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে পাহাড়ের রোজেলা

রোজেলা বা আমিলা, যা পার্বত্য চট্টগ্রামে চুকাই, চুকুরি, মেস্তা, হড়গড়া, হইলফা নামেও পরিচিত, এখন বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষভাবে পরিচিতি পাচ্ছে। এই ফলটি প্রধানত পার্বত্য চট্টগ্রামে পাওয়া যায় এবং তা খাবার, জ্যাম, চাটনি, চা, এমনকি ভেষজ উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। খাগড়াছড়ির কৃষকরা বাণিজ্যিকভাবে রোজেলা চাষ করে লাভবান হচ্ছেন, যা আগে তেমন পরিচিত ছিল না।

রোজেলা, যাকে স্থানীয়ভাবে ‘আমিলা’ বলা হয়, পাহাড়ি অঞ্চলে নানা নামেও পরিচিত। চাকমা ভাষায় ‘আমিলা’, মারমা ভাষায় ‘পুং’, এবং ত্রিপুরা ভাষায় ‘মুখ্রোই বৌথাই’ নামে পরিচিত এই ফলটি এখন বিশেষভাবে জনপ্রিয়। একসময় এ ফলের চাহিদা ছিল না, তবে এখন সারা দেশে এর কদর বেড়েছে। খাগড়াছড়িতে উৎপাদিত আমিলা পাইকারদের কাছে বিক্রি হয় এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠানো হয়।

গবেষকদের মতে, একসময় দেশের প্রায় সব অঞ্চলে এই ফল দেখা যেত, তবে বর্তমানে সিলেট, চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছু অঞ্চলে এখনও এটি পাওয়া যায়। রোজেলা একটি বর্ষজীবী উদ্ভিদ, যার গাছ ঝোপালো এবং ফুলের রং হলুদ এবং মেরুন থাকে। পাতা লালচে-সবুজ এবং ফল লাল হয়ে থাকে। এই ফলটি ভিটামিন বি-৬ ও সি-তে সমৃদ্ধ এবং নানা ধরনের রোগের উপশমে কার্যকরী।

খাগড়াছড়ির কৃষি বিভাগের গবেষকরা জানান, আমিলার ফল এবং পাতা উভয়ই উপকারী। চিংড়ির তরকারি বা টক ঝোলে আমিলা পাতা দিলে তা সুস্বাদু হয়ে ওঠে। পাহাড়ি অঞ্চলের বাসিন্দারা আমিলার খোসা দিয়ে টক রান্না করেন এবং প্রাকৃতিকভাবে পেকটিন থাকার কারণে এটি জেলি তৈরিতেও ব্যবহার হয়। রান্না ছাড়াও রোজেলা চা প্রস্তুত করতে এর বিচি শুকিয়ে ব্যবহার করা হয়।

বিশেষ করে রোজেলা চা এখন বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। পাহাড়ি অঞ্চলের হোটেলগুলিতে এটি সাধারণত তৈরি হয় এবং খাবারের স্বাদ বাড়ানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। খাগড়াছড়ির সিস্টেম রেস্টুরেন্টের পরিচালক আচিং মারমা জানান, রোজেলা চা ছাড়াও ছোট মাছ বা মাংসের রান্নাতেও এটি ব্যবহৃত হয়।

এদিকে, খাগড়াছড়ির শিক্ষার্থী অনিমেষ চাকমা জানান, রোজেলা পাতার টক ঝোল তৈরি করা হয়, এবং ফলের বিচি শুকিয়ে চা প্রস্তুত করা যায়। পাহাড়ের বাসিন্দারা একসময় এটি শুধুমাত্র নিজেদের জন্য চাষ করতেন, তবে এখন বাণিজ্যিকভাবে এর চাষ হচ্ছে। খাগড়াছড়ি শহরের বিভিন্ন বাজারে রোজেলা পাতা ১০-১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে এবং ফল প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১০০-১৫০ টাকায়।

এছাড়া, খাগড়াছড়ির কৃষকরা রোজেলা চাষে লাভবান হচ্ছেন। কলেজ পড়ুয়া সুরেশ ত্রিপুরা জানান, গত বছর তিনি নিজের বাড়ির পাশে কিছু রোজেলা গাছ লাগিয়েছিলেন এবং সেগুলির ফল শুকিয়ে দুই হাজার টাকার বিক্রি করেছেন। এ বছর তিনি জুমের জমিতেও রোজেলা চাষ করেছেন এবং পাইকারদের কাছ থেকে ভালো চাহিদা পাচ্ছেন।

রোজেলা চাষের বাণিজ্যিক সম্ভাবনা ব্যাপক। খাগড়াছড়ি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বাছিরুল আলম জানান, রোজেলা প্রচুর ক্যালসিয়াম এবং লোহা সমৃদ্ধ এবং এর চাষে সেচ কিংবা সার প্রয়োজন হয় না। সমতল এলাকায়ও রোজেলা চাষ সম্ভব এবং এর বাণিজ্যিক সম্ভাবনা অত্যন্ত বেশি।

এভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের এই বিশেষ ফলটি শুধু স্থানীয় খাবারে নয়, দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও বিভিন্ন খাবারের স্বাদ বাড়াতে, চা প্রস্তুত করতে এবং জ্যাম তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে। এর বাণিজ্যিক চাষ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন, যা দেশের অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email