দৃষ্টিনন্দন হযরত সৈয়দ শিবলি আকবরী (রহ.) এর রওজা শরীফ
মো. তাজুল ইসলাম রাজু
বারআউলিয়ার চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর হাওলা অঞ্চলে পোপাদিয়া ইউনিয়নে দরবার-এ গাউছে হাওলার প্রতিষ্ঠাতা হযরত শাহসুফি মাওলানা সৈয়দ আবদুল কুদ্দুছ হুজুর কেবলা (ক.)-এর ৬ পুত্র এবং ৪কন্যার মধ্যে সুযােগ্য দ্বিতীয় পুত্র হযরত শাহ্সূফী মাওলানা সৈয়দ শিবলী আকবরী (রহ.)- জন্ম – ১আগষ্ট ১৯২০ সালে। শিক্ষা অর্জন করেছেন চট্টগ্রাম কলেজিয়েটস স্কুল ও কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে।
বাল্যকাল থেকে বিনয়ী সদালাপি সূফীবাদী হযরত সৈয়দ শিবলি আকবরী (রহ.) বাংলা ভাষায় উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করার পাশাপাশি উর্দুু ও ফার্সি ভাষার চর্চা করে ত্বরিকত বিষয়ে অনেক জ্ঞানলব্দ বিষয় আয়ত্ব করতে সক্ষম ছিলেন। সে সুবাদে তিনি পিতাজির অনেক কাজ-কর্মে তিনি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সংস্পর্শে ছিলেন।
হযরত সৈয়দ শিবলি আকবরী (রহ.) ১৯৫৯ সালে শিক্ষাবোর্ডে চাকরীকালীন সময়ে পিতাজী হুজুর কেবলার চিটি পেয়ে দরবারে চলে আসেন এ্বং ১৯৬০ ইংরেজীতে পিতাজীর ইন্তেকাল পর্যন্ত অবিরাম খেদমতেই ছিলেন। ত্বরিকত প্রচার-প্রসারের ও দরবার শরীফ পরিচালনার যােগ্যতা দেখে পিতাজি তাঁকে খেলাফত প্রদান এবং সাজ্জাদানশীন মনোনীত করেন। ১৯৬০ সালের ১২ এপ্রিল মঙ্গলবার (বাংলা ২৯ চৈত্র, ১৩৬৬ সন) হুজুর কেবলা (রহ.) দুনিয়া থেকে পর্দা নেন।
স্বীয় মুর্শিদ পিতার আদেশ অনুযায়ী হযরত শাহ্সূফী মাওলানা সৈয়দ শিবলী আকবরী (রহ.) ঢাকা শিক্ষা বাের্ডের চাকুরি থেকে ইস্তফা দিয়ে এবং শহুরে আড়ম্বর জীবনযাপন ত্যাগ করে হুজুর কেবলা (ক.) এঁর সকল অনুসারীদের নিয়ে আধ্যাত্মিক চেতনায় দরবার-এ গাউছে হাওলার পরিচালনা শুরু করেন। তিনি গদিনশীন হওয়ার পর ১২ এপ্রিল (বাংলা ২৯ চৈত্র) হুজুর কেবলা (ক.) বার্ষিক ওরশ শরীফ এবং ১৮৬৮ সাল থেকে ১৭ জানুয়ারী (বাংলা ৪মাঘ) হুজুর কেবলা (ক.) কর্তৃক উদযাপিত ওরশ শরীফ নিয়মিত মহাসমারোহে আয়োজন করেন।
তিনি দরবার পরিচালনাকালে আপন মুর্শিদ পিতা এবং সম্মানিত মাতার রওজা শরীফ নির্মাণ, দরবারে নিয়মিত অবস্থানরত ভক্ত মুরিদানদের থাকা খাওয়ার সুব্যবস্থা, অত্র এলাকার চাষাবাদ, রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ, ডাক যােগাযােগ, শিক্ষা ও সমাজ ব্যবস্থার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন৷
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় দরবারের পার্শ্ববর্তী হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা সহ সকল ধর্মের বহু নারী-পুরুষদের পাক হানাদার বাহিনীর বর্বরতার হাত থেকে রক্ষার জন্য দরবারে আশ্রয় দেন এবং তাদের থাকা খাওয়ার সুব্যবস্থা করেন৷ উক্ত সময়ে কিছু গর্ভবতী মহিলাও ছিলেন, যারা দরবার শরীফের পাক ভূমিতে সন্তান জন্ম দেন৷ আশ্রিতদের কয়েকজন পরবর্তীতে দরবার শরীফের নিকটস্থ কধুরখীল উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন, যা অত্র এলাকার লােকমুখে আজো প্রচলিত ৷ যুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিযােদ্ধারা সুযােগ পেলে প্রায়ই দরবার শরীফে আসতেন এবং তিনি তাঁদের সর্বোচ্চ আপ্যায়ন করতেন৷ হযরত সৈয়দ শিবলী আকবরী (রঃ) নানা সময়ে তাদের সহযােগীতাও করতেন ৷
এ ছাড়াও যুদ্ধকালীন সময়ে নিরাপত্তার জন্য বিভিন্ন এলাকার মানুষ দরবারে আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং কিছু সংখ্যক মানুষ ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ শেষে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন ৷ তাদের অনেকেই পরিবর্তীতে দরবার শরীফে নিয়মিত আসা যাওয়ার মাধ্যমে ত্বরিকত অনুসরণ করেন ৷
হযরত শাহ্সূফী মাওলানা সৈয়দ শিবলী আকবরী (রহ.) ১৯৯২ সালে ১৭ জানুয়ারী (বাংলা ৪মাঘ, ১৩৯৯ সন) উদযাপিত ওরশ শরীফে উপস্থিত সকলের সামনে তাঁর তিন শাহজাদাগণকে দরবার পরিচালনার দ্বায়িত্বভার অর্পণ করেন। স্ত্রী, কন্যা, তিন পুত্র এবং অগণিত ভক্তকুল রেখে হযরত সৈয়দ শিবলী আকবরী (রহ.) ১৯৯৩ সালের ১০ই ডিসেম্বর রােজ শুক্রবার (বাংলা ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪০০ সন) দুনিয়া থেকে পর্দা নেন৷
সুযােগ্য তিন গদিনশীন ১. পীরজাদা সৈয়দ নঈমূল কুদ্দুছ আকবরী, ২. পীরজাদা সৈয়দ সাইফুল কুদ্দুছ আকবরী, ৩. পীরজাদা সৈয়দ মুনিরুল কুদ্ছ আকবরী ত্বরিকতের আচরিক পদ্ধতির মাধ্যমে আধ্যাত্মিক চেতনা দ্বারা মানবতার কল্যাণের উদ্দেশ্যে সফল ভাবে দরবার পরিচালনা করছেন ৷ দরবারের অগণিত ভক্তকূল ও মুরিদানদের নিয়ে যথারীতি ১৭ জানুয়ারী (বাংলা ৪ মাঘ) হুজুর কেবলা (কঃ) এঁর বেলায়েত বার্ষিকী ওরশ শরীফ ও হুজুর কেবলা (কঃ) এঁর প্রিয়তমা পত্নীর বার্ষিক ওরশ শরীফ, ১২ এপ্রিল (বাংলা ২৯চৈত্র) হুজুর কেবলার বার্ষিক ওরশ শরীফ এবং ১০ ডিসেম্বর (বাংলা ২৬অগ্রহায়ণ) তাদের মুর্শিদ কেবলার বার্ষিক ওরশ শরীফ উদযাপন করেন ৷
দরবারের সাজ্জাদানশীনদের নিরলস প্রচেষ্টায় বর্তমানে দরবার শরীফের প্রচার ও প্রসার বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে ৷ সাজ্জাদানশীনদের প্রচেষ্টায় বর্তমানে গাউছে হাওলা জামে মসজিদ নির্মাণ সহ নানা সামাজিক উন্নয়ন মূলক প্রতিষ্ঠান নির্মিত হচ্ছে যার মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলাে- (১) পােপাদিয়া ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্স, (২) কমিউনিটি ক্লিনিক, (৩) ১টি উচ্চ বিদ্যালয়, (৪) ২টি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং (৫) হাওলা কুতুবিয়া আলিম মাদ্রাসা।
এ ছাড়া দরবারে গাউছে হাওলা সর্বদা গরীব, দুঃখী ও বিপদগ্রস্থ মানুষদের বিভিন্ন ভাবে সহায়তা করে আসছে ৷ তারই ধারাবাহিকতায় এলাকার গরীব অসহায় রােগাক্রান্ত মানুষের চিকিৎসার লক্ষ্যে মাঝে মাঝে চিকিৎসা সেবা ক্যাম্পের ব্যবস্থা করা হয় ৷
দরবার-এ গাউছে হাওলার একটি অন্যতম ধারা “মাহফিল এ সামা” যা বিশ্বব্যাপী অগণিত ত্বরিকত অনুসারীদের মনের খােরাক ৷ এটি হিন্দোল অলি খাজায়ে খাজেগান খাজা গরীবে নেওয়াজ (রহ.)-এঁর দরবার শরীফে (আজমির শরীফ, ভারত) প্রতিনিয়ত পালিত হচ্ছে ৷ এই সামা মাহফিল মাইজভান্ডার দরবার শরীফ সহ কাদেরিয়া এবং চিশতীয়া ত্বরিকায় পরিচালিত সকল দরবার শরীফে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে ৷ যার মাধ্যমে আধ্যাত্মিক সাধনায় আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জন করা যায় ৷
তৎকালীন সময়ে হুজুর কেবলা (রঃ) কর্তৃক ত্বরিকত প্রচারের সময় বৃহত্তর ময়মনসিংহ এলাকার বহু মরমী সাধক হুজুর কেবলা (ক.)-এর হাতে বায়াত গ্রহণ করেন এবং তাঁরই শানে বিভিন্ন আধ্যাত্মিক সংগীত রচনা করেন যা আজো দরবারের সামা মাহফিলে অত্যন্ত সম্মানের সাথে পরিবেশনা হয় ৷ তাঁদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য কয়েকজন হলেন- বাউল সম্রাট জালাল উদ্দিন খাঁ, রশিদ উদ্দিন খাঁ, মিরাজ আলী, আব্দুল জলিল, তাহের উদ্দিন খাঁ এবং নাম না জানা আরাে অনেকে ৷ তাঁদের লেখার মাধ্যমে বিভিন্ন ভাবে হুজুর কেবলা (কঃ)- এঁর প্রশংসা করেন, যা তাদের পান্ডুলিপিতে উল্লেখ আছে ৷ বাংলা একাডেমি কর্তৃক উক্ত গীতিকারদের নিয়ে বিভিন্ন গবেষণায়ও এর উল্লেখ রয়েছে।
১১ডিসেম্বর সূফীসম্রাট হযরতমাওলানা সৈয়দ শিবলী আকবরী (রঃ) এর ওরশ শরীফে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।