প্রতিবন্ধীদের পাশে দাঁড়ানো ঈমানী দায়িত্ব

মো. তাজবিউল হাসান রুমি

মহান আল্লাহ তায়ালা মানুষকে বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করে থাকেন। কিছু মানুষকে তিনি জন্মগতভাবে শারীরিক কিছু ত্রুটি দিয়ে দুনিয়ায় পাঠান অথবা কেউ জন্মের পর কোনো দুর্ঘটনায় তার অঙ্গহানি বা শারীরিক সমস্যায় পতিত হন, যাকে আমরা প্রতিবন্ধী বলে অবহিত করি। বাস্তবে এদের এমন সৃষ্টির পেছনে তার উদ্দেশ্য ও মহান রহস্য একমাত্র তিনিই জানেন। তবে কিছু কারণ অনুমান করা যেতে পারে, বান্দা যেন মহান আল্লাহর একচ্ছত্র ক্ষমতা সম্পর্কে জানতে পারে যে, তিনি সব বিষয়ে ক্ষমতাবান।

তিনি যেমন স্বাভাবিক সুন্দর সৃষ্টি করতে সক্ষম, তেমন তিনি এর ব্যতিক্রমও করতে সক্ষম। তবে আল্লাহ যাকে সর্বদিক দিয়ে সুস্থ ও নিরাপদে রেখেছেন, সে যেন নিজের প্রতি আল্লাহর দয়া ও অনুকম্পাকে স্মরণ করে। অতঃপর আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। কারণ আল্লাহ চাইলে তার ক্ষেত্রেও সেরকম করতে পারতেন। অন্যদিকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি যেন আল্লাহর ফয়সালায় সন্তুষ্ট থেকে আখেরাতের মহাসফলতা অর্জন করতে পারেন।

প্রতিবন্ধীরা মানব সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তারা আমাদেরই পরিবারের সদস্য। সমাজ ও পরিবারের অন্য সদস্যদের মতো প্রতিবন্ধীদের অধিকার ও ন্যায্য পাওনা সম্পর্কে ইসলাম গুরুত্ব প্রদান করেছে। তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ, স্বাভাবিক ও সম্মানজনক জীবনযাপনের অধিকার রয়েছে। ইসলাম প্রতিবন্ধীদের অধিকার বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ইসলাম প্রতিবন্ধীদের মানবিক মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে মানুষকে কর্তব্য সচেতন হওয়ার ব্যাপারে গুরুত্ব প্রদান করেছে। কারণ প্রতিবন্ধীরা শারীরিক, মানসিক কিংবা আর্থ-সামাজিক অক্ষমতা বা অসুবিধার কারণে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে সক্ষম হয় না। মানুষ হিসেবে আল্লাহর কাছে নারী-পুরুষ, দুর্বল-সবল, প্রতিবন্ধী-সুস্থ সবাই সমান। একের ওপর অপরের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। কেবল আল্লাহভীতিকেই আল্লাহ তায়ালা শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড নির্ধারণ করেছেন। পবিত্র কোরআনে তিনি ঘোষণা করেছেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহর নিকট সেই সর্বাধিক সম্মানিত, যে সর্বাধিক পরহেজগার এবং আল্লাহভীরু।’ (সুরা হুজুরাত : ১৩)।

প্রতিবন্ধী যেমনই হোক সে আল্লাহর সৃষ্টি, আল্লাহর বান্দা। ইসলামের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী তাদের সঙ্গে সদাচরণ করা, সাহায্য-সহযোগিতা এবং তাদেরকে অগ্রাধিকার দেওয়া অবশ্য কর্তব্য। বিপদাপদে প্রতিবন্ধীর পাশে দাঁড়ানো মানবতার দাবি এবং ঈমানি দায়িত্ব। ইসলামের দৃষ্টিতে প্রতিবন্ধী, অসহায়দের সঙ্গে অসদাচরণ বা তাদের সঙ্গে উপহাস, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ বা ঠাট্টা-মশকরা করা হারাম। এতে আল্লাহর সৃষ্টিকে অপমান করা হয়। প্রতিবন্ধীর প্রতি দয়া-মায়া, সেবা-যত্ন সুযোগ-সুবিধা ও সাহায্য-সহযোগিতার হাত সম্প্রসারণ করা মুসলমানদের ওপর একান্ত কর্তব্য।

মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার ন্যূনতম মৌলিক অধিকারগুলো তাদেরও ন্যায্য প্রাপ্য। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তাদের (বিত্তবানদের) সম্পদে বঞ্চিত ও অভাবিদের অধিকার রয়েছে।’ (সুরা জারিয়াহ : ১৯)। তাফসিরে তবারিতে বলা হয়েছে, এক যুদ্ধে মুসলমানরা বিজয়ী হয় এবং গনিমতের সম্পদ লাভ করে। তখন এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। রাসূল (সা.) গনিমতের সম্পদের একটি অংশ অসহায়, দরিদ্র, প্রতিবন্ধীদের নামে বিলিয়ে দিতে বলেন।’ (তাফসিরে তবারি: ২৬/১৫৮)। অন্যত্র নবী (সা.) বলেন, ‘তোমরা ক্ষুধার্তকে খাদ্য দাও, অসুস্থ ব্যক্তির খোঁজখবর নাও এবং বন্দিদের মুক্ত করে দাও।’ (বুখারি : ৫০)

নবী কারিম (সা.) প্রতিবন্ধীদের সর্বদাই অত্যন্ত ভালোবাসতেন এবং বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম (রা.)-কে নবীজি (সা.) অপার স্নেহে ধন্য করেছেন। যখনই তাকে দেখতেন, বলতেন, স্বাগত জানাই তাকে যার সম্পর্কে আমার প্রতিপালক আমাকে ভর্ৎসনা করেছেন। হজরত আনাস (রা.) হতে বর্ণিত, নবী কারিম (সা.) এ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সাহাবিকে দুবার মদিনার অস্থায়ী শাসক নিযুক্ত করেছিলেন। (মুসনাদে আহমাদ : ১৩০০০), যা পৃথিবীর ইতিহাসে এক দুর্লভ ঘটনা। নবীজি মদিনার বাইরে কোথাও গেলে তাকে তার স্থলাভিষিক্ত করে যেতেন। এজন্য প্রতিবন্ধীকে ভালোবাসা, তাদের সঙ্গে সদাচরণ করা নবী (সা.)-এর অনুপম সুন্নত বটে।

প্রতিবন্ধীদের ইসলামের বিধান পালনে শিথিলতা করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা কাউকে তার সাধ্যাতীত কোনো কাজ দেন না।’ (সুরা বাকারা : ২৮৬)। অন্যত্র বলেন, ‘দুর্বল, রুগ্ণ, ব্যয়ভার বহনে অসমর্থ লোকদের জন্য কোনো অপরাধ নেই।’ (সুরা তওবা : ৯১)। আল্লামা কুরতুবি (রহ.) তার বিখ্যাত তাফসিরগ্রন্থে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘আয়াতটি শরয়ী বিধান পালনে অক্ষম ব্যক্তি থেকে বিধান রহিত করার মূলনীতি। সুতরাং যে ব্যক্তি যে বিধান পালনে অক্ষম হয়ে যাবে, সে বিধান তার থেকে রহিত হয়ে যাবে।’ (তাফসিরে কুরতুবি : ৪/৫৪৮)

ইসলাম প্রতিবন্ধী, অক্ষম ও দুর্বল ব্যক্তিদের অনেক কঠিন কাজ সহজ করে দিয়েছে এবং তাদের থেকে কষ্ট দূর করার বিধান দিয়েছে। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তিন ব্যক্তি থেকে কলম উঠিয়ে রাখা হয়েছে—ঘুমন্ত ব্যক্তি যতক্ষণ না সে জাগ্রত হয়, নাবালেগ যতক্ষণ না সে বালেগ হয় এবং পাগল যতক্ষণ না সে জ্ঞান ফিরে পায় বা সুস্থ হয়।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২০৪১)

অন্ধ লোককে পথ না দেখিয়ে বিপথগামী করা, তাদেরকে অনর্থক কষ্ট দেওয়া ও উপহাস করা থেকে নবী (সা.) কঠোরভাবে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেন, ‘সেই ব্যক্তি অভিশপ্ত, যে অন্ধকে পথ ভুলিয়ে দিল।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ১৮৭৫)

রাসূলুল্লাহ (সা.) আমর ইবন জামুহ (রা.)-কে সম্মান ও মর্যাদা দিয়ে বলেছিলেন, ‘তোমাদের সর্দার হলো ফরসা ও কোঁকড়ানো চুলবিশিষ্ট আমর ইবনে জামুহ।’ (হিলয়াতুল আউলিয়া : ৭/৩১৭)

আবু কাতাদাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার আমর ইবনে জামুহ (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এসে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমি যদি আল্লাহর পথে জিহাদ করে শহীদ হই, তাহলে জান্নাতে আমি কি সুস্থ ও স্বাভাবিক পায়ে হাঁটতে পারব? তার পা পঙ্গু ছিল। রাসূল (সা.) বললেন, হ্যাঁ। উহুদের যুদ্ধে তিনি, তার এক ভাইয়ের ছেলে ও তাদের একজন দাস শহিদ হন। তার কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় রাসূল (সা.) তাকে লক্ষ্য করে বললেন, আমি যেন তোমাকে জান্নাতে সুস্থ ও স্বাভাবিক পায়ে হাঁটতে দেখছি। রাসূল (সা.) তাদের দুজন ও গোলামকে এক কবরে দাফন করার আদেশ দিলেন, ফলে তারা তাদেরকে এক কবরে দাফন করল।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ২২৫৫৩)

আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইবনে উম্মে মাকতুম (রা.) মদিনায় দুইবার তার স্থলাভিষিক্ত করেছেন এবং তিনি অন্ধ হওয়া সত্ত্বেও সালাতের ইমামতি করেছেন। (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ১৩০০০)

রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পর মুসলিম খলিফারাও প্রতিবন্ধীদের ব্যাপারে তার পথ অনুসরণ করেন। তারা রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিবন্ধীদের শারীরিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, মানসিক ও তাদের সব ধরনের প্রয়োজন পূরণ করেছেন। খলিফা ওমর ইবনে আবদুল আজিজ (রহ.) সব প্রদেশে ফরমান জারি করেন, সব অন্ধ, অক্ষম, প্লেগ রোগী ও এমন অঙ্গবৈকল্য, যা তাকে সালাতে যেতে বাধা দেয়, তাদের পরিসংখ্যান তৈরির আদেশ দেন। ফলে তারা এসব লোকের তালিকা করে খলিফার কাছে পেশ করলে তিনি প্রত্যেক অন্ধের জন্য একজন সাহায্যকারী নিয়োগ করেন, আর প্রতি দুজন প্রতিবন্ধীর জন্য একজন খাদেম নিযুক্ত করেন, যে তাদের দেখাশোনা ও সেবা করবে।

উমাইয়া খলিফা ওয়ালিদ ইবন আবদুল মালিকও প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে কাজ করেন। তিনি সর্বপ্রথম প্রতিবন্ধীদের দেখাশোনার জন্য বিশেষ ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সেবাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। ৮৮ হিজরি মোতাবেক ৭০৭ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত এসব শিক্ষাকেন্দ্রে ডাক্তার ও সেবক নিয়োগ করেন। প্রতিবন্ধীদের নিয়মিত ভাতা প্রদান করেন। সব অক্ষম, পঙ্গু ও অন্ধের জন্য খাদেম নিযুক্ত করেন।

সভ্যতার ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী সম্পর্কে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টিভঙ্গি ও দায়িত্ববোধের পরিবর্তন হচ্ছে। সাম্প্রতিকালে বিভিন্ন দেশ প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর নানাবিধ কল্যাণ ও উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণসহ আন্তর্জাতিক ফোরামে প্রতিবন্ধী বিষয়ক বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণের অঙ্গীকার প্রদান করছে। এটা খুবই ভালো খবর। আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, শুধু আইনি সুরক্ষা প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সমাজে সহজগম্যতা বা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের জন্য যথেষ্ট নয়। এজন্য প্রয়োজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তির প্রতি আমাদের সমাজে বিদ্যমান নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করা। ইসলাম তাদেরকে যেভাবে সম্মান ও মর্যাদা দিয়েছে তা সবার মনে রাখা দরকার। আল্লাহর কাছে তাকওয়া ছাড়া শারীরিক অবকাঠামোর কোনো মূল্য নেই। প্রতিবন্ধীরাও মানুষ। আর আল্লাহ পুরো মানবজাতিকে সম্মানিত করেছেন।

প্রতিবন্ধীর মানসম্মান সংরক্ষণ, মানুষ হিসেবে তাদের অধিকার প্রদান এবং তাদের সঙ্গে কোমল আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। তারা যাতে অবহেলা ও অবজ্ঞার শিকার না হয় এবং সমাজে একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে জীবন যাপন করার অধিকার পায়, সেই ব্যবস্থা করতে বলেছে ইসলাম। শুধু প্রতিবন্ধী নয়, যেকোনো ধরনের অসুস্থ ও অক্ষম ব্যক্তির প্রতি মানবিক ও সহযোগিতাপূর্ণ আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছে।

আমাদের দায়িত্ব হলো, নিজের সুস্থতার জন্য আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা এবং প্রতিবন্ধী ভাইদের জন্য দোয়া করা। ইসলাম তাদের যেসব অধিকার দিয়েছে তা যথাযথভাবে আদায় করা। যথাসম্ভব প্রতিবন্ধীদের সাহায্য-সহযোগিতা করা। সেটা অন্ধ ব্যক্তিকে রাস্তা চলায় সাহায্য করা হোক কিংবা তাদের জীবনযাপনের ক্ষেত্রে সাহায্য করা হোক কিংবা তাদের শিক্ষাদানে সহযোগিতা হোক। প্রতিবন্ধীর দেখাশোনা করা অভিভাবকের জন্য জরুরি। আর সমষ্টিগতভাবে সব মুসলিমের জন্য ফরজে কিফায়া। অর্থাৎ সমাজের কিছু লোক তাদের দেখাশোনা করলে বাকিরা গুনাহগার হবে না।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email