বিজয়ের এক পঞ্চাশে তরুণ প্রজন্ম

সাহাদাৎ রানা

এক পঞ্চাশ(৫১)! শুধু একটি সংখ্যা নয়, একটি মাইলফলক, একটি আবেগের নামও। একটি বিশাল অর্জনের প্রাপ্তিও। ১৯৭১ থেকে ২০২১ বাঙালি জাতির জন্য এক দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার আনন্দও। সত্যিই বাঙালি জাতির জন্য আজ বিশাল আনন্দের দিন। বিজয়ের ৫০ বছর আজ। ১৯৭১ সালের আজকের দিনে ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বিজয় এসেছিল। আজ স্বাধীন বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছর। বাঙালি জাতি আজ আনন্দের সঙ্গে বিজয়ের ৫০ বছর উদ্যাপন করছে। বিজয়ের আনন্দ উদ্যাপনের পাশাপাশি আরো সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে বিশে^র বুকে গড়ে তুলতে হলে সবাইকে কাজ করতে হবে যার যার জায়গা থেকে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে। তরুণ প্রজন্মকে তৈরি করতে হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়। তবেই সম্ভব বিশে^র বুকে আগামীতে প্রভাবশালী রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া। তরুণদের মধ্যে সেই চেতনাই জাগ্রত করতে হবে। কারণ আজকের তরুণরা আগামী দিনে নেতৃত্ব দেবে দেশকে। যাদের সঠিক নেতৃত্ব ও সুন্দর কর্মকাণ্ডে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবে দেশ। কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জিত হবে- এটাই সবার প্রত্যাশা। কারণ বিশ্ব মানচিত্রে অন্যসব দেশের চেয়ে লাল-সবুজের বাংলাদেশ নামটা সবার কাছেই আলাদা। বাংলাদেশকে বিশে^র বুকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্থান পেতে মূল্য দিতে হয়েছে ৩০ লাখ শহীদের তাজা রক্ত ও সঙ্গে লাখ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি। এত সবকিছুর বিনিময়ে আমরা অর্জন করেছি বিজয়। পেয়েছি লাল-সবুজ পতাকা।

পৃথিবীর ইতিহাসে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, প্রতিটি দেশের স্বাধীনতাণ্ডসংগ্রামে একজন বড়মাপের নেতার সন্ধান পাওয়া যায়। যাদের নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন বা প্রতিষ্ঠিত হয়। উদাহরণ হিসেবে আমেরিকায় যেমন ছিলেন জর্জ ওয়াশিংটন। লেলিন ছিলেন রাশিয়ার। চীনের ছিলেন মাও সেতং। আর আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের ছিলেন মহাত্মা গান্ধী। যারা নিজ নিজ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় রেখেছিলেন অগ্রণী ভূমিকা। তেমনি আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ক্ষেত্রে যার অবদান সবচেয়ে বেশি, তিনি আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যার কারণে আমরা পেয়েছি আমাদের সোনার বাংলা, প্রিয় মাতৃভূমি।

আমাদের জন্য সবচেয়ে আনন্দের খবর হলো- বাঙালি জাতির রয়েছে হাজার বছরের গৌরবের ইতিহাস। যে ইতিহাস পৃথিবীর হাতেগোনা দু-একটি দেশের ভাগ্যে জোটে। সব দেশের নেই ভাষার জন্য রক্ত দেওয়ার ইতিহাস। শত্রুকে পরাজিত করে দেশ স্বাধীন করার ইতিহাস। যে স্বাধীনতার জন্য আমাদের দিতে হয়েছে ৩০ লাখ শহীদের বুকের তাজা রক্ত। সঙ্গে লাখ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রবহানি। আর সঙ্গে কয়েক কোটি মানুষের সীমাহীন আত্মত্যাগ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধে পরাজিত করে তবেই ১৬ ডিসেম্বর ছিনিয়ে এনেছি বিজয়।

এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, আমাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস একটি অনুপ্রেরণার নাম। কারণ, বিশ্ব মানচিত্রে যত দিন বাংলাদেশ থাকবে, থাকবে বাঙালি জাতি। এটাই আমাদের কাছে শ্রেষ্ঠ গৌরবের অধ্যায়। যে অধ্যায়ে অনুপ্রাণিত হয়ে দেশ গঠনে কাজ করতে হবে। আর সেই কাজটা আগামীতে করতে হবে তরুণ প্রজন্মকে। কারণ তারাই হবেন দেশের ভবিষ্যৎ কর্ণধার। তাদের নেতৃত্বে এগিয়ে যাবে দেশ। তাই তরুণ প্রজন্মকে জানাতে হবে আমাদের দেশের জন্ম ইতিহাসের কথা। মুক্তিযুদ্ধের কথা, বঙ্গবন্ধুর কথা। মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধের সময়ের কথা। আমাদের দেশের তরুণ প্রজন্ম অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে গেলেও ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে আগ্রহ কম। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিষয়ে। এর দায় অবশ্য অভিভাবকদের। তাই তরুণ প্রজন্ম যেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আগামীতে দেশের দায়িত্ব নিতে পারে তাদের সেভাবে তৈরি করার দায়িত্ব এখন আমাদের। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তাদের সামনে উপস্থাপন করতে হবে। এ কথা বলার কারণ তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এখন ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে আগ্রহ খুবই কম। তাদের মধ্যে সেই আগ্রহ তৈরি করতে হবে। অবাধ তথ্য-প্রযুক্তির যুগে জানার ক্ষেত্র অনেক প্রশস্ত হলেও, তারা শুধু এখন নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। অবশ্য এ ক্ষেত্রে আমাদের বড়দেরও দায় রয়েছে। তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে তোলার দায়িত্ব অভিভাবক থেকে শুরু করে সমাজ ও রাষ্ট্রের। তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখিত বই, মুক্তিযুদ্ধের ওপর নির্মিত বিভিন্ন চলচ্চিত্র, নাটক, প্রবন্ধ আরো বেশি বেশি করে তাদের সামনে তুলে ধরতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে স্বাধীনতার জন্য আমাদের অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান, মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে দেশকে স্বাধীন করেছেন। যেখানে ছিলেন শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, কৃষক, শ্রমজীবী থেকে শুরু করে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। তাদের অবদানের ফসল স্বাধীনতা, আমাদের প্রিয় জন্মভূমি।

আমাদের এ ক্ষেত্রে কিছু উদ্যোগ নিতে হবে। তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গল্প, উপন্যাস ও কবিতার বই উপহার দিতে হবে। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে দেশ স্বাধীন হয়েছে, সে বিষয়টি নতুন প্রজন্ম, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের সামনে বারবার তুলে ধরতে হবে। এখানে লেখকদেরও কিছু দায়িত্ব রয়েছে। বিশেষ করে যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছে তাদের আরো বেশি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গল্প, কবিতা, উপন্যাস ও নাটক লিখতে হবে। গবেষকদের উচিত মুক্তিযুদ্ধের অনেক না জানা ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করা। মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের কথা তুলে ধরা। এখানে প্রকাশকদেরও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে। তাদের দায়িত্ব মুক্তিযুদ্ধের ওপর আরো বেশি করে বই প্রকাশ করা। স্কুল-কলেজের লাইব্রেরিতে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু সম্পর্কিত বইয়ের সংখ্যা আরো বাড়াতে হবে। প্রতি মাসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক কবিতা, চিত্রাংকন, রচনা, উপস্থিত বক্তৃতা, সাধারণ জ্ঞানের প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে হবে। এখনো এমন প্রতিযোগিতা অনেক প্রতিষ্ঠানে হয়, তবে তা শুধু স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। এখন স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসের পাশাপাশি সারা বছরই শিক্ষার্থীদের জন্য এমন প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে হবে। এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। সারা বছর বিশেষ করে প্রতি মাসে যদি এমন শিক্ষামূলক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা সম্ভব হয়, তবে মেধাবী শিক্ষার্থী তৈরি হবে। সবাই বেশি করে জানতে পারবে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস। নিজেকে যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারবে।

মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসই আমাদের সবার জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের কাছে আরো ব্যাপক। দেশের প্রতিটি নাগরিকের মধ্যে যদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উন্মেষ ঘটে তবে দেশ তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে। তাই আর সময় নষ্ট না করে তরুণ প্রজন্মকে ভবিষ্যতের জন্য তৈরি করতে আমাদের এখনই কাজ শুরু করা উচিত। এর ফলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শানিত হবে তরুণ প্রজন্ম। একটি গতিশীল জাতি তৈরি হবে- বিজয়ের এই এক পঞ্চাশে দাঁড়িয়ে এটাই হোক আমাদের শপথ।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email